বাংলাদেশর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা নিদর্শন জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। প্রাচীন যুগ থেকে আজকের বাংলাদেশ যতগুলো সিড়ি পার করেছে তার সবকটির চিহ্ন ধরে রেখেছে জাতীয় জাদুঘর। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণা কাজে নিয়োজিত রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে ঢাকা জাদুঘর নামে আত্মপ্রকাশ করে আজকের জাতীয় জাদুঘর। ১৯১৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে এর উদ্বোধন করেন তদানিন্তন বাংলার গভর্নর লর্ড কার মাইকেল। ১৯৭০ পাকিস্তান সরকার ঢাকা জাদুঘর কমিটির পরিবর্তে ঢাকা জাদুঘর প্রযত্ন বোর্ড অধ্যাদেশ জারি করে একে সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় রূপ দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৩ সালে ঢাকা জাদুঘরকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত।
রাজধানী ঢাকার শাহাবাগ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে এর অবস্থান।
পরিদর্শনের সময়সূচী, ভিড়ের দিনগুলো
- বৃহস্পতিবার বাদে সপ্তাহের অন্যসব দিন এই সংগ্রহশালা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সাপ্তাহিক ছুটি ও জাতীয় দিবসগুলোতে এখানে বেশী ভিড় হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকাল, শীতকাল ও রমজান মাস পরিদর্শনের সময়সূচি এই তিনটি ভাগে বিভক্ত।
- গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল – সেপ্টেম্বর) শনিবার – বুধ (সকাল ১০.৩০ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে)
- শীতালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) শনিবার – বুধ (সকাল ৯.৩০ টা থেকে বিকাল ৪.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে)
- রমজান মাস: শনিবার – বুধ (সকাল ৯.৩০ টা থেকে বিকাল ৩.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে)
টিকেট সংগ্রহ তথ্য
- কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে জাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। কাউন্টার প্রধান গেইটের পাশে অবস্থিত।
টিকেট মূল্য
- ৩ – ১২ বছর পর্যন্ত ৫ টাকা
- ১২ বছর এর উপরে ১০ টাকা
- বিদেশী দর্শনার্থী ৭৫ টাকা।
- জাতীয় দিবসগুলো যেমন – পহেলা বৈশাখ, ২৬শে মার্চ ও ২১শে ফ্রেব্রুয়ারিতে শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।
প্রবেশ সতর্কতা, গমন/নির্গমন, গাইড
- জাদুঘরে প্রবেশের সময় দর্শনার্থীরা ইচ্ছা করলে গাইডের সাহায্য নিতে পারেন। দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ৭ জন গাইডের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। প্রবেশকালে ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস নিচে সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে রেখে যেতে হবে। ক্যামেরা ও খাবার জিনিস সঙ্গে রাখা যাবে না, মোবাইল বন্ধ রাখতে হবে। জাদুঘরের গমন-নির্গমন ব্যবস্থা একমুখী।
ভবনের যেখানে যা দেখতে পাবেন
- জাদুঘর প্রাঙ্গণটি নানান রকম গাছে সুসজ্জিত। ভবনের প্রবেশ দ্বারের দু’পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক দুটি কামান। ৪ তলা বিশিষ্ট ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে নান্দনিক নভেরা ভাস্কর্য। এই ভবনের প্রথম তলায় অফিস, হল রুম ও অন্যান্য। ২য়, ৩য় ও ৪র্থ তলায় ঐতিহাসিক সকল নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে যা প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত।
- দ্বিতীয় তলায় গেলে দর্শনার্থীরা সামগ্রিক বাংলাদেশ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, গাছপালা, জীবজন্তু, উপজাতি জনজীবন, শিলা, খনিজ, সুন্দরবন ও অতীত সময়ের বিভিন্ন মুদ্রা ও স্থাপত্য।
- তৃতীয় তলায় সজ্জিত আছে –
- অস্ত্রশস্ত্র, চীনামাটির শিল্পকর্ম, পুতুল ও বাদ্যযন্ত্র, বস্ত্র ও পোশাক-পরিচ্ছদ, নকশী কাঁথা, পান্ডুলিপি, সমকালীন শিল্প ও আবহমান বাংলাদেশ। বিশ্বসভ্যতা ও শিল্পকলা সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
- চতুর্থ তলায় সজ্জিত আছে, বিশ্ব মনীষীদের প্রতিকৃতি, বিশ্ব শিল্পকলা, বিশ্ব সভ্যতা প্রভৃতি।
সংরক্ষণের মান ও ব্যবস্থাপনা
- জাদুঘরে অতি মূল্যবান কিছু নিদর্শন রয়েছে যা কখনও পুনরায় সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এসকল নিদর্শনগুলো খুব সতর্কতার সাথে স্টোরে সংরক্ষিত রয়েছে যার সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রহরী।
গ্যালারী
- প্রাকৃতিক ইতিহাস, জাতিসত্তা ও শিল্প, ইতিহাস ও ধ্রুপদী এবং সমকালীন শিল্পকর্ম ও বিশ্ব সভ্যতা এই চারটি বিভাগে বিভক্ত সংগ্রহশালার গ্যালারী।
প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ
- গাছপালা, প্রাণী বৈচিত্র্য ও পতঙ্গের অস্তিত্বের ইতিহাস দিয়ে সাজানো প্রাকৃতিক ইতিহাস গ্যালারীতে।
জাতিসত্ত্বা ও শিল্প বিভাগ
- বাঙ্গালী ঐতিহ্যের পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবন প্রণালী, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, রীতি রেওয়াজ, অলংকার ও প্রাচীন বাংলার নানান নিদর্শন জায়গা করে নিয়েছে এই গ্যালারীতে।
ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা
- এই গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং বেশ কিছু প্রত্ন নিদর্শন দিয়ে।
সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্ব সভ্যতা
- শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, পটুয়া কামরুল হাসান ও এস.এম. সুলতানের মত বরেণ্য শিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগৃহীত আছে এই বিভাগে। এছাড়াও রয়েছে চীন, নেপাল, ভূটান, মিশর ও ইরানের সংস্কৃতির নিদর্শন।
বিশেষ দিবস ভিত্তিক প্রতিযোগিতা, দলগত প্রবেশের সুযোগ
- জাতীয় দিবসগুলোতে ঐ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপরে চিত্রাঙ্কন, রচনা আবৃত্তি ও হাতের লেখার প্রতিযোগীতার আয়োজন করে থাকে জাতীয় জাদুঘর। প্রতিযোগীতা শিশু থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত।
- স্কুল, কলেজ অথবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করে দলগতভাবে জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগ পেতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ প্রবেশ মূল্য ফ্রি করে দেন।
অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরী, ক্যান্টিন
- বিভিন্ন প্রকার সভা, সেমিনার আয়োজনের সুবিধার্থে জাদুঘর অডিটোরিয়াম ভাড়া নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অডিটোরিয়ামের মোট ৩টি রুম রয়েছে। বড় রুমের ভাড়া ১৪,০০০ টাকা (সারাদিন)। ছোট রুমের ভাড়া ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ টাকা (সারাদিন)।
- জাদুঘরের নিজস্ব লাইব্রেরী দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত। এখানে রয়েছে ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ বই। যা গবেষণার কাজে সহায়তা করে। নিচতলায় সিড়ির দক্ষিণ পাশে জাদুঘরের নিজস্ব ক্যান্টিন রয়েছে। যেখানে চা, কফি ও বিস্কুট পাওয়া যায় তবে দাম তুলনামূলক একটু বেশী।
লিফট, গাড়ি পার্কিং ও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা
- ৪ তলা বিশিষ্ট ভবনে দুটি সিড়ি ও ৩টি লিফট রয়েছে। লিফট শুধুমাত্র বৃদ্ধ ও ভি.আই.পিদের ব্যবহারের জন্য। ভবনের দক্ষিণ পাশে ১২০টি গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। গাড়ি পার্কিং এর জন্য কোন চার্জ দিতে হয় না। এই সংগ্রহশালার প্রতি ফ্লোরে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রয়েছে এবং নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল রয়েছে।
No comments:
Post a Comment